তখন সম্ভবত ক্লাস সেভেন বা এইটে পড়ি। এরমধ্যেই একদিন প্রথম আলোর ঈদসংখ্যায় দেখলাম হুমায়ূন আহমেদের একটা উপন্যাস, নাম ‘আঙুল কাটা জগলু’। বাসায় এই লেখকের অনেক বই আছে, কিন্তু ‘বড়দের বই’ হবার কারণে এসবের অধিকাংশই থাকতো আমার নাগালের বাইরে। প্রথমদিনেই তাই কেউ টের পাবার আগেই এই ‘বড়দের লেখকের’ লেখা উপন্যাস ‘আঙুল কাটা জগলু’ পড়ে ফেললাম। তখন বয়ঃসন্ধি পার করছি, নিজের মধ্যে সবসময় কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগে। এই উপন্যাস পড়ে সেই অস্থিরতা যেন আরও বেড়ে গেলো! বলতে লজ্জ্বা নেই, আঙুল কাটা জগলু পড়ে জীবনের প্রথমবারের মতো আমি সুচিত্রা-উত্তমের যুগের নায়িকাদের মতো বিরহী-বিরহী চেহারার মিতুর প্রেমে পড়ে গেলাম! জীবনের প্রথম প্রেম, সে অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো না!
অনেক কষ্টে লুকিয়ে লুকিয়ে লেখকের আরও দুই-তিনটা বই পড়লাম। তখন মাথার ভিতরে বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে হিমুর কথা। বেঁচে থাকতে হলে আমাকে হিমু হতেই হবে। বাসায় তো আর হলুদ পাঞ্জাবির কথা বলতে পারি না, তাই সমবয়সীদের সাথে দার্শনিক কথাবার্তা বলা আর খালি পায়ে হাঁটা দিয়েই শুরু করলাম। দুই-তিনদিন যেতে না যেতেই দেখা গেলো আমার পায়ে ফোস্কা পড়ে গেছে। ততোদিনে বাসায় আমার হিমুপ্রীতির খবর পৌঁছে গেছে। তখনকার মতো বকাঝকা করে আমার মাথা থেকে হিমুর ভূত সরানো হলো।
এসএসসি পরীক্ষা দেবার পরে বাসা থেকে সবরকম ‘বড়দের বই’ পড়ার অনুমতি পেয়ে গেলাম। একে একে পড়ে ফেললাম জোছনা ও জননীর গল্প, শঙ্খনীল কারাগার, জলিল সাহেবের পিটিশন থেকে শুরু করে মিসির আলি, হিমু সিরিজের প্রায় সব লেখা। মাথায় তখন আবার হিমু হবার ভূত ঢুকলো, সেই ভূত এখনো পুরোপুরি নামেনি।
অনেকেই বলেন হুমায়ূন আহমেদ বাজারি লেখক। তাঁর লেখাকে ‘সাহিত্য’ বলা যায় না, তাঁর জনপ্রিয়তা খুবই সস্তা দরের, ইত্যাদি ইত্যাদি। একেবারেই নিম্নমানের পাঠক হিসেবে এতকিছু আমি বুঝিনা, সত্যিকথা বলতে বোঝার ইচ্ছাও নেই। আমি এটুকু বলতে পারি, হুমায়ূন আহমেদের লেখা দিয়েই আমার নিজের এবং আমার মতো আরও অনেকের বই পড়ার অভ্যাসটার জন্ম হয়েছিলো। হুমায়ূন আহমদের লেখা পড়েই অসংখ্য তরুণ-তরুণী হিমু কিংবা রূপা হতে চেয়েছে। হুমায়ূন আহমদই আমাদের জোছনা দেখতে শিখিয়েছেন। হুমায়ুন আহমেদের সৃষ্ট সংলাপ ‘তুই রাজাকার’ দিয়েই কিছুদিন আগে পুরো বাংলাদেশ কেঁপেছিলো। শুধু বাংলাদেশে কেন, পুরো পৃথিবীতে এমন কয়টা মানুষ আছে যারা সাহিত্য, চলচ্চিত্র, সংগীত সব ক্ষেত্রেই সফলভাবে অবদান রেখেছেন?
ফেসবুকে আজকাল অনেকেই হুমায়ূন আহমেদকে অনুকরণ করে লেখেন। সবাই যে খুব ভালো লেখেন তা হয়তো না, তবে বেশিরভাগই বেশ ভালো লেখা। কিন্তু আমি কেন জানি সেসব লেখা পুরোপুরি পড়তে পারি না। পৃথিবীতে কেউই অন্য কারো মতো না। হুমায়ূন আহমেদের মতো হওয়া হয়তো সহজ, কিন্তু সত্যিকারের হুমায়ূন আহমেদের অভাব পূরণ করা অসম্ভব।
অনেকের মতো আমিও হুমায়ূন আহমেদের চলে যাওয়াটাকে খুব সহজে মেনে নিতে পারিনি। যে মানুষটার লেখা বই দিয়ে পড়ার অভ্যাস শুরু হয়েছিলো, যার তৈরি কাল্পনিক চরিত্রকে অসংখ্য মানুষ নিজের মধ্যে ধারণ করতে চায়; তাঁর চলে যাওয়া মেনে নেয়াটা আসলেই বেশ কঠিন। আমি সবসময় চেষ্টা করি ‘হুমায়ূন আহমেদ নেই’ এই কথাটা মনে না করতে। কেউ যদি নিজের মধ্যে একটা বিশ্বাসকে বাঁচিয়ে রাখতে চায় তাহলে ক্ষতি কী?
আজ হুমায়ূন আহমেদের ৬৫ তম জন্মদিন। একসময়ে হুমায়ূন আহমেদকে ‘বাজারি লেখক’ বলা অনেকেই আজ বিভিন্ন টক-শো তে ইনিয়ে বিনিয়ে বলবেন হুমায়ূন আহমেদ কত ভালো মানুষ ছিলেন, উনার লেখা বাংলা সাহিত্যে কতটুকু অবদান রেখেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। হুমায়ূন আহমেদের জন্য আসলে এসবের প্রয়োজন নেই। হুমায়ূন আহমেদকে এসব দিয়ে মাপা যায় না। হুমায়ূন আহমেদকে মাপার জন্য মনেহয় একটাই স্কেল আছে, সেটা হলো মানুষের ভালোবাসা।
পৃথিবীর আকাশে আজ খুব বেশি চাঁদের আলো নেই। হুমায়ূন আহমেদ যেখানে আছেন, সেখানকার আকাশ নিশ্চয়ই চাঁদের আলোয় প্লাবিত হচ্ছে।
শুভ জন্মদিন হুমায়ূন আহমেদ। এই মুহূর্তে আপনি যেখানে বেঁচে আছেন, সেখানে আপনার বেঁচে থাকা অনেক ভালো হোক।